ঘরে ঘরে আওয়াজ তুলুন জীবনের প্রতি হ্যাঁ মাদকের প্রতি না: সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট
মাদক ও মাদকাসক্তির হার কমাতে সরকার আন্তরিক। এ কাজে সরকারকে সহায়তা করছে জাতিসংঘ। এর পাশাপাশি সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগের বিকল্প নেই। মাদকের অপকারিতা ও এর সর্বনাশা গ্রাস থেকে উত্তরণের উপায় বর্ণনা করেছেন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, আমতলী


নাঈম মৃধা, তালতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি: বিশ্বের বর্তমান সমাজব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বড় বাধা এবং আতঙ্কের নাম মাদক। বাংলাদেশ এ বলয়ের বাইরে নয়। অপার সম্ভাবনাময় অগণিত তরুণ-তরুণী নেতৃত্ব দিতে পারতো সমাজ ও দেশের উন্নয়নে; কিন্তু মাদকের নিষ্ঠুর থাবায় তারা সমাজ ও দেশের বোঝা হয়ে গেছে। এ প্রলয়ঙ্করী ধ্বংসলীলাকে অবলীলায় চলতে দিলে সবুজ বৃক্ষরাজি, বিচিত্র পশুকুল, পাখির কলতান ও সৃষ্টির সেরা মানুষের এ সুন্দর পৃথিবী একদিন বিরান হয়ে যাবে। তাই সমাজের প্রতিটি সচেতন মানুষকে মাদকবিরোধী সামাজিক যুদ্ধে শরিক হতে হবে।
মাদক গ্রহণের কারণে ব্যক্তির মন-মানসিকতায় নেতিবাচক পরিবর্তন আসে, স্বাভাবিকতা নষ্ট হয় এবং সঠিকভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আমাদের দেশে ব্যবহৃত মাদকদ্রব্য হচ্ছে গাঁজা, ফেনসিডিল, মদ, হেরোইন, ইয়াবা, ঘুমের ট্যাবলেট, সুচের মাধ্যমে মাদক ইত্যাদি।
মাদকদ্রব্য সেবন করে সাময়িক আনন্দ ও তৃপ্তি পাওয়া যায়। এ আনন্দ ও তৃপ্তি উপভোগ করতে পুনরায় মাদক গ্রহণ করা হয়। এভাবে মাদকদ্রব্য সেবনের একটি প্রবণতা তার মধ্যে জš§ নেয়। এক সময় দেখা যায় ব্যক্তি নির্দিষ্ট অথবা একাধিক কোনো মাদকের প্রতি শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্ভর হয়ে পড়ে। মাদক প্রাপ্তির চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকে সব সময়। এটিই হচ্ছে আসক্তি বা মাদকাসক্তি।
বিভিন্ন মাদকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
গাঁজা: মানসিক ভারসাম্যহীন করে তোলে।
মদ: লিভার ও পেটের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়।
ফেনসিডিল: কিডনির কার্যক্ষমতা লোপ পায়।
হেরোইন: শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
ইয়াবা: স্নায়ুতন্ত্রের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
ঘুমের ট্যাবলেট: মস্তিষ্কের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
আঠা ও ড্যান্ডি: স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
সুচের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ: এইডস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে।
মাদকাসক্তি: সমস্যা ও বাংলাদেশ পেক্ষাপট
পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশে এ সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আমাদের সমাজে মাদকাসক্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। দেশে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা নিয়ে আজও কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ১৯৯৬ সালে ইউনাইটেড নেশন ড্রাগ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম দেশের তিনটি শহরে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা জরিপ করে। তাদের জরিপে ১০ লাখের একটা সংখ্যা আমরা পাই; সে হিসেবে দেশে বর্তমানে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৫০-৬০ লাখ। এ মাদকাসক্তের শতকরা ৯১ ভাগ কিশোর, যুবক ও তরুণ। ১০ বছর আগে বেশিরভাগ আসক্তদের মাদকদ্রব্য শুরুর বয়স ছিল ১৫-১৭ বছর। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ১২-১৩ বছরে। এখন মেয়েরাও সমানতালে মাদকের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে।
আসক্তির বিস্তার ঘটেছে ছাত্র ও শিক্ষিত বেকারদের মধ্যেও। জীবনের সবচেয়ে কর্মক্ষম ও সুবর্ণ সময়টাকে তারা ব্যয় করছে মাদকের পেছনে। মাদকাসক্ত ছাত্ররা পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাদের পড়ালেখার মান কমে যায়। এভাবে চলতে চলতে এক সময় পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। তারা জীবিকা অর্জনের উপায় হারিয়ে ফেলে। কোনো কাজে হাত দিলেও বেশিদূর এগোতে পারে না।
মাদক গ্রহণে প্রয়োজন টাকা। এ কালো ও অতিরিক্ত টাকার জন্য তারা পরিবারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে, তৈরি করে অশান্তি। শুরু করে ভাঙচুর ও বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজ। প্রতারণা, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি অপকর্মে তারা জড়িয়ে পড়ে। বেশিরভাগ সময় দেখা যায় তারা প্রয়োজন মেটাতে মাদক বিক্রির সঙ্গেও জড়িত হচ্ছে। নারী মাদকাসক্তরা নেশার টাকা জোগাতে পতিতাবৃত্তিও করছে।
মাদক সম্পর্কে গণসচেতনতা
মাদকের বিরূপ প্রভাব থেকে যুবসমাজ ও পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। মাদকের বিভিন্ন কুফল নিয়ে পরিবারের সবার সঙ্গে আলোচনা করা এবং সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা ব্যবহার করা উচিত। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। সামাজিকভাবেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মাদক সংক্রান্ত যে কোনো অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করতে হবে। যুবসমাজ বা বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের পরিবেশ গড়ে তোলা দরকার। সামাজিকভাবে এর কুফল নিয়ে আলোচনা সভা চালিয়ে যেতে হবে। স্কুল ও কলেজে মাদকের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের মাদক থেকে দূরে থাকার শপথ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি জনমত নির্বিশেষে পরিবারিক ও সামাজিকভাবে মাদকের প্রভাবকে প্রতিহত করার মানসিক দৃঢ়তা গড়ে তুলতে হবে