জীবাশ্ম জ্বালানি করোনার চেয়েও ভয়াবহ, তবু নীরব বিশ্ব
কিছু সমস্যা তূলনামূলক কম প্রকট হওয়া সত্ত্বেও ব্যাপক গুরুত্ব পায়, আবার বেশ কিছু সমস্যা মারাত্মক হওয়া সত্ত্বেও যথাযথ মনোযোগ পায় না- এমন অভিযোগ বেশ পুরোনো।


বিবিএস নিউজ ডেস্ক: সমস্যা প্রকট হওয়া সত্ত্বেও গুরুত্ব না পাওয়ার তালিকায় প্রথম সারিতে উঠে এসেছে জীবাশ্ম জ্বালানি। এর ভয়াবহ প্রভাব সম্পর্কে জানেন বিশ্বনেতারা। কিন্তু তারা উদাসীন। এমনকি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের কারণে বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা সর্বোচ্চ হওয়া সত্ত্বেও।
Google News গুগল নিউজে বিবিএস নিউজ 24’র খবর পড়তে ফলো করুন
জীবাশ্ম জ্বালানির প্রভাব করোনার চেয়েও ভয়াবহ, সে রকম তথ্যই উঠে এসেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, প্রায় তিন বছরে করোনা আক্রান্ত হয়ে ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের বদৌলতে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে ৯০ লাখ মানুষ। মূলত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের কারণে মানুষের শরীরে যে বায়ুবাহিত ক্ষুদ্র কণা প্রবেশ করে, সেটি থেকেই এভাবে মৃত্যু হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা প্রভাবে মানুষের মৃত্যুর হিসাব বাদ দিয়েই ওই সংখ্যার কথা বলা হয়েছে।
২০২১ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহাম ও ইউনিভার্সিটি অব লিসেস্টারের একটি গবেষক দলের করা প্রতিবেদনে বলা হয়, জীবাশ্ম জ্বালানির ফলে সৃষ্ট বায়ুদূষণে বিশ্বে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন মারা যায়। ওই গবেষণায় বলা হয়, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট দূষিত সূক্ষ্ম কণায় (পিএম২.৫) ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮৭ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। জীবাশ্ম জ্বালানি দূষণ শুধু জলবায়ু সংকটের জন্য দায়ী নয়, এটি প্রতিবছর এইচআইভি, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়ার চেয়ে বেশি লোককে হত্যা করে। এই দূষণের সঙ্গে হৃদরোগ, ক্যানসার, টিস্যু ড্যামেজ, অ্যাজমাসহ শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতার মতো বিস্তৃত গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সম্পর্ক প্রমাণিত।
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের এক মতামতে বলা হয়েছে, নতুন ও অপরিচিত কোনো প্রবণতাকে ভয়াবহ এবং অগ্রহণযোগ্য হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষমতা মানুষের মধ্যে কম। কিন্তু নতুন সমস্যা নিয়ে যদি যথাযথ আলোচনা হয়, আন্দোলন হয়, তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে সমাজে একটা প্রভাব তৈরি হয়। অন্যদিকে কোনো সমস্যা নিয়ে প্রথমে ব্যাপক উৎসাহ থাকলেও তা কোনো কারণে যদি ধরে না রাখা যায়, তাহলে যতই গুরুত্বপূর্ণ বা ভয়াবহ হোক, তা সরকার বা নীতিনির্ধারকদের মনোযোগের কেন্দ্র থেকে সরে যায়। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তা নিয়ে অবহেলা দেখা দেয়। এভাবে চলতে থাকলে সমস্যাটা একসময় ঘনীভূত হয়। মহাবিপর্যয় আকারে হাজির হয়। এমন বিপর্যয় যা মোকাবিলা করা মানুষের পক্ষে বেশ দুষ্কর হয়ে পড়ে। এর দরুন মানবসমাজকে নজিরবিহীন আর্থ-সামাজিক মূল্যও গুনতে হয়।
কথা হলো, জীবন-মরণের মতো জ্বলন্ত কোনো প্রশ্নকে অন্যভাবেও সামাল দেওয়া যায়, যথাযথভাবে মোকাবিলা করা যায়। গত শতকের ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলন তার শক্তিশালী উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্রের ওই নাগরিক অধিকার আন্দোলনের ফলে বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম ইত্যাদির ভিত্তিতে বৈষম্যগুলো সামনে চলে আসে। এক কথায়, সমাজের দগদগে প্রশ্নগুলো এড়িয়ে না গিয়ে সমাধানের লক্ষ্যে সমাজের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের ওপর চাপ তৈরি হয়। প্রশ্নগুলো মাঠে-ঘাটে, গণমাধ্যমে, সাংস্কৃতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণায় হাজির রাখা হয়। ফলে বিষয়গুলোর প্রতি নজর দিতে বাধ্য হয় সরকার।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের মতো জলবায়ু পরিবর্তন বা জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার নিয়েও আন্দোলন দরকার। এতে করে বিকল্প বা নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে জনপ্রিয় করে তোলার কাজটি সহজ হবে। রক্ষা পাবে প্রাণ ও প্রকৃতি।
২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে স্থানান্তর সম্ভব হলে বস্তুগত ও রাজনৈতিক ক্ষতি এবং ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য হারে কমবে। কারণ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন করতে কোনো প্রচলিত জ্বালানির দরকার হয় না। তাই নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সরকারগুলোকে একবার অভ্যস্ত করা গেলে তার সুফল হবে অসীম।
বিখ্যাত জলবায়ুকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ একবার বলেছিলেন, জলবায়ু বিপর্যয় থেকে বাঁচতে হলে নীতিনির্ধারকদের ‘ক্যাথিড্রাল থিংকিং’ করতে হবে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ নতুন করে ভাবতে হবে। চিন্তার নতুন ভিত্তি রচনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নতুন যাত্রা কোন তীরে গিয়ে পৌঁছাবে তা সব সময় আগে থেকে ভাবা যায় না। যেমন : ব্যাটারি প্রযুক্তি ব্যাপক হারে উন্নত হচ্ছে এবং লিথিয়ামের বদলে পরিবেশে আরও ভালোভাবে বিদ্যমান অন্যান্য উপাদান দিয়ে ব্যাটারি তৈরির গবেষণা জোরেশোরে চলছে। গত সপ্তাহেই নতুন ঘোষণা সামনে এসেছে। তাতে বলা হয়েছে, চীনে জেএসির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে হাত দিয়েছে ফোকসওয়াগন। তারা চাইছে সোডিয়াম-আয়ন প্রযুক্তির ব্যাটারি তৈরি করতে।