দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যশোর ৫ আসনে আ’লীগের মনোনয়ন প্রার্থী ১০
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কপোতাক্ষ নদ, নকশিকাঁথা, খেজুরের গুড় আর জামতলার রসগোল্লা প্রসিদ্ধ এসব জিনিস নিয়ে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের তীর্থভূমি যশোর।


নিজস্ব প্রতিনিধি: এই জেলার সংসদীয় আসন ছয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই আসন গুলোতে প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
বড় দল এবং দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকায় এই জেলার প্রায় প্রতিটি আসনে এবার দলের মনোনয়ন চাওয়া প্রার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাশী অনেকেই মাঠে নেমেছেন। তারা বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি কেন্দ্রেও যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। এছাড়া মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেক জায়গায় অভ্যন্তরীণ বিরোধের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। তবে সবার কথা একটিই নেত্রী যাকে নৌকা দেবেন তার জন্য সবাই একযোগে কাজ করবেন।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজেলা যশোরের মণিরামপুর। এ উপজেলার ১৭ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে যশোর-৫ সংসদীয় আসন। আসনটি বরাবর আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে এই আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরই নির্বাচিত হয়ে আসছেন। তবে এবার জেলার অন্য উপজেলার চেয়ে এখানে দলটির মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা অনেক বেশি। ক্ষমতাসীন এই দলটির অন্তত ১০ নেতা এই আসনে মনোনয়ন পেতে মাঠে রয়েছেন। সেজন্য বাড়ছে দলীয় কোন্দল। আর এই কোন্দল নেতাকর্মীদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ চান, এখানে প্রার্থী বদল হোক। আর বিএনপি চায় আওয়ামী লীগের এই কোন্দলের সুযোগ নিতে। যদিও এই মুহূর্তে নির্বাচন নিয়ে ভাবছে না বিএনপি। তারা এক দফার আন্দোলনে রয়েছে। সুতরাং প্রার্থিতার জন্য বাড়তি চাপ নেই বিএনপির নেতাদের। কেবলমাত্র মনোনয়ন প্রত্যাশীরা নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি, জমিয়াতে উলামায়ে ইসলাম ও জামায়াতের প্রার্থীরা নির্বাচনি তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিগত ১১ সংসদ নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পাঁচ বার, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী একবার ও বাকি পাঁচবার বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জমিয়েতে উলামায়ে ইসলামের প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন।
১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পিযুষ কান্তি ভট্টাচার্য নির্বাচিত হন।
১৯৭৯ সালে বিএনপির আফসার আহমেদ সিদ্দিকী বিজয়ী হন।
১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস নির্বাচনে জয়লাভ করেন।
১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের খান টিপু সুলতান নির্বাচিত হন।
এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির আফসার আহমেদ সিদ্দিকী ও ৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের খান টিপু সুলতান পুনরায় সংসদ নির্বাচিত হন।
২০০১ সালে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মুফতি ওয়াক্কাস আবারো নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের খান টিপু সুলতান।
এরপর ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে নৌকার টিপু সুলতানকে পরাজিত করেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী স্বপন ভট্টাচার্য।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে স্বপন ভট্টাচার্য পুনরায় নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রিসভায়ও ঠাঁই পান।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মণিরামপুর আসনে আওয়ামী লীগের অন্তত ১০জন নেতাকর্মীর নাম আলোচনায় রয়েছে। তারা হলেন- স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আব্দুল মজিদ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য এসএম ইয়াকুব আলী, আওয়ামী লীগ নেতা কামরুল হাসান বারী, অ্যাডভোকেট খান টিপু সুলতানের স্ত্রী ডাক্তার জেসমিন আরা, পুত্র কেন্দ্রীয় যুবলীগ ও জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য হুমায়ুন সুলতান, জেলা যুবলীগের সভাপতি ও যশোর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী, মণিরামপুরের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন লাভলু। এ ছাড়া বর্তমান এমপি স্বপন ভট্টাচার্যের সহোদর আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পীযূষ কান্তি ভাট্টাচার্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলনের নামও রয়েছে আলোচনায়।
বিএনপি’র মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন- মণিরামপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র অ্যাডভোকেট শহীদ মোহাম্মদ ইকবাল, জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মুছা, জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ইফতেখার সেলিম অগ্নি। তারা তিনজনই মাঠে রয়েছেন। এছাড়াও জামায়াতের গাজী এনামুল হক, জাতীয় পার্টির যশোর জেলার সভাপতি শরিফুল ইসলাম সরু চৌধুরী ও মণিরামপুর উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি এমএ হালিমের নামও ঘুরছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায়।
উপজেলা আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বরাবরই মণিরামপুর আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হলেও এখানে দলের মধ্যে বিভাজন রয়েছে। বর্তমান এমপি স্বপন ভট্টাচার্য আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী হয়েও নির্বাচন করেছেন অতীতে। পরে দলের মনোনয়নে নির্বাচিত হলেও নেতাকর্মীদের উল্লেখযোগ্য অংশ তার সঙ্গে নেই বলেও দাবি অনেকের। এ ছাড়া এলাকার বিভিন্ন পর্যায় থেকে তার বিরুদ্ধে দখলদারিত্ব, অনিয়মসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। আর ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনসহ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও তার বিতর্কিত ভূমিকা রয়েছে বলে স্থানীয় নেতাদের দাবি।
অন্যদিকে, এমপি’র অনুসারীদের দাবি, মণিরামপুরে আওয়ামী লীগ অনেক শক্তিশালী। বড় দল তাই অনেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন। কিন্তু স্বপন ভট্টাচার্য পর পর দুই বার এমপি হওয়ায় এলাকায় বেশ উন্নয়ন হয়েছে। বর্তমানে তিনি স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী। এলাকায় তিনি নিয়মিত আসেন এবং দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেন। তাই মণিরামপুরবাসী আবারও তাকেই এমপি হিসাবে দেখতে চান। মনোনয়ন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমি মনোনয়ন চাইব। আর কে মনোনয়ন চাইবেন তা আমি জানি না। বিএনপি এলেও এখানে ফেয়ার নির্বাচন হবে, না এলেও হবে।
মনোনয়ন প্রত্যাশী আরেক নেতা জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আব্দুল মজিদ বলেন, ‘ছাত্রজীবন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ১৯৮১ সালে ঢাকার ধানমন্ডি থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। এর আগে, ১৯৮০ সালে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলাম। দলীয় সভানেত্রী আমার অতীত রাজনীতি জানেন। আমি মনোনয়নের ব্যপারে আশাবাদী। মনোনয়ন পেলে মণিরামপুরবাসীর জন্য আরও বেশি কাজের সুযোগ পাব।
রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। আর কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাঠে আছে স্থানীয় বিএনপি। তবে দলটির নেতাকর্মীরা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের মাঠে নামেনি। কোথাও নির্বাচনমুখী প্রচার বা দলীয় কর্মকাণ্ড নেই তাদের। কেন্দ্র সিদ্ধান্ত দিলে নির্বাচনমুখী হবেন তারা। সেক্ষেত্রে যাকেই ধানের শীষ দেওয়া হোক না কেন সবাই তার জন্য কাজ করবেন। তাই নমিনেশন পাওয়া নিয়ে দলটিতে লড়াইয়ের তেমন তীব্রতা নেই। অপরদিকে, জাতীয় পার্টিরও আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড তেমন চোখে পড়েনি। আর নিবন্ধন ও রাজনৈতিক জটিলতায় জামায়াতে ইসলামীর দলীয় অবস্থানও সেভাবে চিহ্নিত হয়নি। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে বোঝা যাবে তারা কীভাবে, কাদের সঙ্গে মাঠে অবস্থান নেবে।
মণিরামপুরে বিএনপি ও জামায়াতের কিছু রিজার্ভ ভোটও রয়েছে। সেই ভোটের উপর ভর করে আওয়ামী লীগের কোন্দলের সুযোগ নিতে চায় বিএনপি। ২০০১ সাল থেকে বিএনপি বা জোট নির্বাচনে অংশ নিলেও মনোনয়ন পেয়েছেন জোটের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মুফতি ওয়াক্কাস। বর্তমানে তিনি প্রয়াত। ফলে নির্বাচনি জোট হলে এই আসনটা ছাড়তে নারাজ বিএনপি।
মণিরামপুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক পৌর মেয়র মোহাম্মদ শহীদ ইকবাল বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি করছি। বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করছি। তাদের বিপদে-আপদে বুক দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করি। এখানে হামলা, মামলা, পুলিশি আতঙ্ক থাকলেও বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা খুবই সুদৃঢ়। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ধানের শীষ বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে।
নির্বাচনে মনোনয়নের বিষয়ে যশোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাবেরুল হক সাবু বলেন, ‘আমরা অবাদ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে এক দফার আন্দোলনে আছি। যতক্ষণ বর্তমান সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে দায়িত্ব না দিচ্ছে ততক্ষণ আমাদের নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। নির্বাচনে গেলেই কেবল প্রার্থিতার প্রশ্ন। সেক্ষেত্রে দলীয় হাইকমান্ড যাকে মনোনয়ন দেবে তার সঙ্গে সবাই থাকব। আমাদের কোনো বিভাজন নেই। দীর্ঘদিন জনগণ নির্যাতিত হচ্ছে, সমস্যা সংকুল সময় পার করছে। জনগণ এখন মুক্তি চাইছে। নির্বাচন হলে তারা বিএনপিকেই ভোট দেবে।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে ভোটার ছিল ৩ লাখ ১৯ হাজার ৮৪ জন। ভোট দেন ২ লাখ ৭৫ হাজার ৭৪ জন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্বপন ভট্টাচার্য বিজয়ী হন। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ২ লাখ ৪২ হাজার ৮৭২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ৪ দলীয় ঐক্যজোট প্রার্থী মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস ধানের শীষ প্রতীকে পান ২৪ হাজার ৬২১ ভোট।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী স্বপন ভট্টাচার্য বিজয়ী হন। কলস প্রতীকে তিনি পান ৭৮ হাজার ৪২৪ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের খান টিপু সুলতান। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ৫৮ হাজার ৪১৮ ভোট। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের খান টিপু সুলতান বিজয়ী হন। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ১ লাখ ১৯ হাজার ৯১৪ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ৪ দলীয় ঐক্যজোট প্রার্থী মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পান ১ লাখ ৩ হাজার ৭৩৯ ভোট।