

জানা গেলো ব্যবসায়ীরা নাকি কথা দিয়েছেন আসন্ন রমজানে পণ্যমূল্য বাড়াবেন না। বিষয়টি অবশ্য শর্তযুক্ত। তারা বলেছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ঠিকভাবে পেলে কোনও পণ্যের দাম বাড়বে না।
এমন কথা তারা প্রতিবছরই দিয়ে থাকেন এবং কোনও বছরই সেটা সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে থাকে না। কারণ, পবিত্র রমজান মাসই তাদের ব্যবসা করার শ্রেষ্ঠ সময়। অন্যান্য দেশে যা হয়, এখানে হয় ঠিক তার উল্টো। বাংলাদেশে কোনোকালেই উৎসব-পার্বণে পণ্যের দাম কমানোর নজির নেই, আর আগামীতেও নজির সৃষ্টি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।
রমজান আসতে এখনও অনেক দিন বাকি। তবে এর মধ্যেই রান্নার তেল থেকে নুনসহ খাদ্যপণ্যের রেকর্ড মূল্য বৃদ্ধিতে নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত তো বটেই, সাধারণ মধ্যবিত্তের মাথায়ও এখন হাত পড়েছে। অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল থেকে রান্নার গ্যাস, ঘরে আলো জ্বালানোর বিদ্যুৎ সবকিছুর দাম আকাশছোঁয়া। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর এরমধ্যেই জানিয়েছে, রোজার মাসে চাহিদা বেড়ে যায় এমন পণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি হতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্যে প্রভাব তো আছেই, তবে ডলারের বিনিময় হারের কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে।
পণ্যের বাজারে কোনও সরবরাহ ঘাটতি থাকবে না বলে জানিয়েছে সরকার ও ব্যবসায়ী গ্রুপ। তবে একটা বড় ধারণা আছে যে বাজারে পণ্যের ঘাটতি না থাকলেও ব্যবসায়ীরা যোগসাজশ করে পণ্যের দাম বাড়ায়, যাতে বাজার অস্থিতিশীল করা যায়। রমজানের ঠিক আগে আগে এমন কিছু প্রতিজ্ঞা করেন ব্যবসায়ী নেতারা, তবে বাস্তবতা ভিন্ন। রমজান আসার অনেক আগে থেকেই পণ্যমূল্য বাড়ানো হতে থাকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এবং রমজানের মাঝেও বাড়ানো হয়।
দেশের ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের বাজার মূলত জিম্মি হয়ে পড়ছে অল্প কিছু বড় কোম্পানির কাছে। এরা যেমন ব্যাংক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তেমনি এদের হাতেই পণ্যবাজারের সিংহভাগ। আমাদের প্রতিযোগিতা কমিশন এই একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান কীভাবে ঘটাবে সেটা বড় জিজ্ঞাসা। নীতিনির্ধারণী স্তরেও ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রতিনিধিরা বসে আছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ী, অর্থমন্ত্রী ব্যবসায়ী এবং আরও মন্ত্রী, এমপিদের বড় অংশ ব্যবসায়ী। ফলে বাজারে ব্যবসায়ীদের স্বার্থটা যত বড় করে বিবেচ্য হয়, মানুষের জন্য ভাবনাটা তেমন থাকে না। রমজানে বেশি ব্যবহার হবে এমন পাঁচটি পণ্য হলো–ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, খেজুর ও ছোলা। এগুলো আমদানি করে দেশের শীর্ষ ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারকরা। এই পণ্যগুলো নিয়েই শুরু হয় কারসাজি। খেলোয়াড় আর রেফারি যদি একই দলের হয়, তাহলে ফলাফল যা হওয়ার, তেমনি অবস্থা আমাদের ভোগ্যপণ্যের বাজারে।
যদি বাজারে চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জোগান না থাকে, সে ক্ষেত্রে চাহিদাজনিত মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে পারে। বাংলাদেশে অর্থনীতির এই সাধারণ তত্ত্ব খাটছে না। এখানে দৃশ্যমান একটা প্রভাব দেখা যাচ্ছে বড় কিছু কোম্পানির।
দুই বছরের কোভিড এবং এক বছরের যুদ্ধে বহু মানুষ কর্মহীন হয়েছে, রোজগার হারিয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পর্যুদস্ত হয়েছে। তাই সামগ্রিকভাবে মানুষের আয় বাড়েনি। এ অবস্থায় এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম, কয়েক দফায় বিদ্যুতের দাম এবং গ্যাসের দাম বাড়ানোর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পণ্য উৎপাদন ও পরিবহনে। আইএমএফ-এর চাপের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দুর্নীতি ও অপচয় হ্রাস করা গেলেও মানুষের ওপর এত বড় চাপ দিতে হতো না সরকারকে।
ডলার সংকট সত্ত্বেও সরকারি সহযোগিতা নিয়ে প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি করেছে বড় কোম্পানিগুলো। সেই তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট ও মাঝারি মূলধনের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য আমদানি করতে পারেনি এবং এখনও পারছে না। কারণ, এসব প্রতিষ্ঠান ঋণপত্র (এলসি) খুলতে চাহিদামতো ডলার পায়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে ভোগ্যপণ্যের শীর্ষ কোম্পানিগুলো এবার বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে। বিশ্ববাজারে কমলেও ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ বাজারে চিনির দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ইচ্ছেমতো। ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রেও আমরা আগে এমন কাণ্ড দেখেছি। তাই রমজানে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে মানুষকে ভুগতেই হবে সেটা নিশ্চিত।
কারসাজির আশঙ্কা আছে বিধায় নজরদারি বেশি প্রয়োজন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। অনেক উন্নত দেশেও পরিস্থিতি জটিল ছিল। তবে বাজারের উত্তাপ এখন কম। দাম কমার তালিকায় আছে সয়াবিন তেল, পামতেল, মসুর ডাল, ছোলা ও চিনি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের এপ্রিল-জুন সময়ে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম প্রায় ১ হাজার ৯০০ ডলার ছিল। এখন তা ১ হাজার ৪০০ ডলারের নিচে নেমেছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম কমার সুফল কেন আমরা পাচ্ছি না তার একটা উত্তর প্রয়োজন।
একটি বড় কারণ, দেশে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। আবার আমদানি ব্যয় বেড়েছে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং এর ফলে কর বেশি দিতে বাধ্য হওয়ায়। বাস্তবতা হলো, স্বাভাবিক সময়ের মতো বেশি পরিমাণে রোজার পণ্য আমদানির সক্ষমতা এখন নেই। তবে রোজার আগে যেসব পণ্য আমদানি হচ্ছে, তা যেন বাজারজাত অব্যাহত থাকে, সেদিকে নজর রাখতে হবে সরকারকে।
লেখক: সাংবাদিক