বরিশাল

বরিশালে হোগলা পাতায় সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরেছে নারীদের

পুষ্প বালা।বরিশাল সদর উপজেলার পশ্চিম চরআইচা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন গ্রামের এক নারী।বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই হলেও একটু ভালো থাকার আশায় সংসারের কাজ গুছিয়ে বাড়তি আয়ের যোগান দিতে প্রতিনিয়ত বুনছেন হোগলা পাতার পাটি।

মাসুমা জাহান: শুধু যে তিনি এমনটা নয়,তার আশপাশের বিভিন্ন বাড়ির নারীরাও উপার্জন বাড়াতে সন্তান লালন-পালনসহ সাংসারিক কাজের ফাঁকে হোগলা পাতার পাটি বুনে চলেছেন বছরের পর বছর,যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলছে।

এদিকে প্লাস্টিকের পণ্যের চাহিদার মধ্যেও তাদের হাতে বোনা হোগলা পাতার পাটির চাহিদা রয়েছে বরিশালজুড়ে এমনটা জানিয়ে পুষ্প বালা বলেন,গোটা বরিশালে আমাদের হাতে বোনা পাটি দেখতে পাবেন।আর এটাই আমার ও আশপাশের নারীদের কাছে গর্বের।

তিনি বলেন,দিন যত যায় ততই উৎপাদন সংকটের অজুহাতে হোগলা পাতার দাম বেড়েছে।আর চড়া দামে হোগলা পাতা সংগ্রহ করে শ্রম দিয়ে পাটি বুনে বিক্রি করে খরচ ওঠানোটাই দায় হয়ে পড়েছে।

তবে কখনো শ্রমের হিসেবের কথা চিন্তা করতে পারিনি,কারণ সেই হিসেব কষলে এ পাটি বুনে সংসারে যে টাকার যোগানটা আসে তাই হত না।হিসেব কষি এটাই,যে সংসারের কাজের ফাঁকে যে সময়টা পাই,তাতে তো কিছু একটা করছি।কিছু টাকা রোজগারও করছি।

পুষ্প বালা বলেন,একটি হোগলা পাতার পাটি বুনে বিক্রি করলে ১৫ থেকে ১০০ টাকা থাকে।আর মাসজুড়ে যদি ১৫-২০টি পাটি তৈরি করে বিক্রি করা যায় তাহলে মোটামুটি যে টাকাটা আসে তাতে সংসারের কোনো না কোনো কাজে লাগছে।

শুধু এ অঞ্চল নয়,হাতে তৈরি হোগলা পাতার পাটির দেশজুড়ে চাহিদা রয়েছে জানিয়ে দিপু রানী বলেন,পাটি বুনে লাভের পরিমাণটা কিঞ্চিত হলেও চাহিদার কারণে আমাদের হাতে বোনা পাটির কদর বেশি।

এ পাটি বরিশাল শহরসহ জেলা ও বিভাগজুড়ে বিভিন্ন এলাকায় পাইকারদের হাত ধরে চলে যাচ্ছে।এ পাটি মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব কোরবানি,মাহফিল,যেকোনো ধর্মের মানুষদের বিয়ের অনুষ্ঠানে রান্নাঘরের কাজে এমনকি মানুষের মৃত্যুর সময়ও কাজে লাগছে।যার বিকল্প প্লাস্টিকের পাটি বা পলিথিন দিয়ে হয় না।

তিনি বলেন,৩০ বছরের মতো হলো শ্বশুর বাড়িতে এসেছি, তখন দেখতাম শাশুড়ি, ননদ ও জায়েরা এ কাজ করছে। তখন শাশুড়ির কাছ থেকে কাজ শিখে এখন পর্যন্ত পাটি বোনার কাজ করছি।আর এখন আমার হাত ধরে ছেলের বউও পাটি বুনে সংসারে নিজের সক্ষমতার জানান দিচ্ছে।

প্লাস্টিকের পণ্যের মতো হোগলা পাতার পাটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক নয় বলে জানিয়ে এ প্রজন্মের নারী খুকু রানী বলেন,বরিশাল সদর উপজেলার চরআইচা, শায়েস্তাবাদ ও এর আশপাশের কিছু গ্রামে হোগলা পাতার পাটি বোনার কাজ করা হয়।

ঘরের পুরুষরা হোগলা পাতা সংগ্রহ করে দিলে তা শুকিয়ে পাটি তৈরি পর্যন্ত কাজ করে থাকেন নারীরা। তাও আবার সন্তানদের লালন-পালনসহ সংসারের সব কাজের ফাঁকে পাটি বোনার এ কাজটি করা হয়।

তিনি বলেন, আগের প্রজন্মের হাত ধরে নতুন প্রজন্মের তেমন কেউ এ কাজে আগ্রহী হতে চায় না। তবে ঘরে বসে থাকার চাইতে যদি পাটি বুনে বিক্রি করে কিছু টাকা নিজের হাতে রাখা যায় তাতে দোষ কী।

আবার আমাদের হাতে তৈরি হোগলা পাতার পাটি বিক্রি করতে বাইরের বাজারে যেতে হয় না, পাইকাররা এসে নিয়ে যায়। তাই সবদিক চিন্তা করে পাটি বোনার কাজটি শিখে নিয়েছি।

তবে দুঃখ একটাই, এখান থেকে পাইকারদের যে টাকায় পাটি দিচ্ছি শহরে গিয়ে দেখছি তার থেকে দেড়গুণ বেশি দামে পাটি বিক্রি হচ্ছে। তাহলে আমরা পাচ্ছি কী? যদি শ্রমের মূল্য ধরি তাহলে তো লোকসান ছাড়া কিছুই হচ্ছে না।

তবে সরকার সুযোগ করে দিলে এবং সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলে বড় পরিসরে বাণিজ্যিক আকারে পাটি তৈরি করা সম্ভব বলে জানান মিলন কুমার সাজ্জাল, কার্তিক চন্দ্র সাজ্জাল, অনিক কুমার করসহ চরআইচা গ্রামের পুরুষরা।

তারা বলেন, এ পাটির চাহিদা অনেক। মাঘ-ফাল্গুনের মাহফিল আর ইজতেমা এলেই এর চাহিদা এতটাই বেড়ে যায় যে, পাইকারের দেওয়া টার্গেট অনুযায়ী কাজ দিতে পুরুষদেরও ঘরের নারীদের সহায়তা করতে হয়।

আশপাশে যাদের বাড়িতে পাটি বোনার কাজ হয়, সেসব বাড়ির পুরুষরা হয় জমিতে চাষাবাদ, নয়তো দিনমজুরের কাজ করেন। আর এসব কাজের ফাঁকে পাটি বোনার কাঁচামাল সংগ্রহ করা, শুকিয়ে দেওয়াসহ নানা কাজে সহায়তা করেন। তবে ব্যয় বাড়লেও শ্রমের মজুরি না ওঠায় বড় পরিসরে পাটি বোনার কাজ কেউ করতে চায় না।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button