জাতীয়দেশজুড়ে

বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি

মে মাস থেকে আলোচনা ডিসেম্বরে ঘোষণা

বিবিএস নিউজ ডেস্ক: অবশেষে ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে এলো বহুল প্রত্যাশিত সেই সংবাদ— ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস সেই ২৫ মার্চের রাতের পর থেকে, এই স্বীকৃতির আশা ছিল মানুষের মনে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মুখ খুললেই সবাই উৎসাহী হয়ে উঠতেন, স্বীকৃতি ঘোষণার অপেক্ষায়। ভারতের সরকারি ও বিরোধীদলের মধ্যেও বারবার এই বিষয়ে আলাপ হয়েছে মাসের পর মাস। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। প্রশ্ন তোলা হয়— চাইলেই ইন্দিরা গান্ধী আরও আগে এই স্বীকৃতি দিতে পারতেন কিনা। কিন্তু ওই সময়ে ইন্দিরা নিজেই উত্তর দিয়েছেন একাধিকবার।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে উল্লেখ আছে, স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১৯৭১ সালের ৭ মে সকালে বিরোধী নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বৈঠকে বসেছিলেন। প্রায় সবাই বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। সবার কথা শোনার পর প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তার মর্ম এরকম— বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের প্রতি ভারত পূর্ণ সমর্থন জানাবে, কিন্তু বাংলাদেশকে এখনই কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া সে দেশেরই স্বার্থের পরিপন্থী হবে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি প্রচুর সহানুভূতি থাকলেও স্বীকৃতির ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা চলছে। তবে তাজউদ্দীন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না— এমন কথা তিনি বলেননি, বা তার সরকার এ ব্যাপারে ঠিক কী করবে, তার কোনও আভাস দেননি। শুধু স্পষ্টভাবে বলেছেন, পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে নানা উসকানিমূলক কাজ করছে। ভারতকে নানাভাবে বাংলাদেশের ব্যাপারে জড়াতে চাইছে। যাই হোক, ভারত যা ঠিক মনে করবে, তা করতে ভীত নয়।

ভারতের অধিকাংশ বিরোধী নেতা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য দাবি জানান। পরিস্থিতি সম্পর্কে ইন্দিরার বিশ্লেষণ তারা মেনে নেননি। তারা বলেন যে, বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। স্বীকৃতি দিয়ে মেনে নেওয়া দরকার এবং তাতে সেখানকার আন্দোলন জোরদার হবে। ভারত এ বিষয়ে দেরি করলে ভারতেরই ক্ষতি হতে পারে। স্বীকৃতির দাবি জানায়— সিপিএম, সিপিআই, ডিএমকে, জনসংঘ, আদি কংগ্রেস ও পিএসপি।

সিপিআই’র ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত তার দলের পশ্চিমবঙ্গে কমিটির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে একটি স্মারকলিপি দেন। সিপিএম থেকে বলা হয়, পাকিস্তানকে ভয় না করে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকম সাহায্য দেওয়া হোক। অটল বিহারী বাজপেয়ী, চিত্ত বসু, ত্রিদিব চৌধুরী, এনজি গোরে একই দাবি করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, পাকিস্তানি ফৌজের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত ১৫ লাখ লোক ভারতে এসেছে। আরও আসবেন। এজন্য ত্রাণকার্য সম্পর্কে কী করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনি বিরোধী নেতাদের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠকে বসবেন। তবে ওই বৈঠক কবে হবে তা ঠিক হয়নি।

বাংলাদেশ সম্পর্কে আলোচনার জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এক বৈঠকে মিলিত হয় ১৯৭১ সালের এই দিন (৬ ডিসেম্বর)। এই বৈঠক পূর্ব নির্ধারিত ছিল না। বিরোধী দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পরেও শ্রীমতি গান্ধী স্বল্প সময়ের নোটিশে তার সহকর্মীদের ওই বৈঠকে আহ্বান করেন।

যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা স্বীকৃতির দিনটি স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, পাকিস্তান তখন যুদ্ধক্ষেত্রে এমনিতেই দিশেহারা। ভারতের স্বীকৃতির উত্তরে উন্মাদ শাসকরা শুধু কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা ছাড়া তেমন কিছু করতে পারেনি। ৬ ডিসেম্বর সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে পড়ছে। ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখ ছাড়া আর এই ৬ তারিখে খুব সম্ভব বাঙালিদের জীবনে আনন্দের দিন ছিল। সেই দিনের অনুভূতি একজনের কাছে এক এক রকম। যারা যুদ্ধক্ষেত্রে রেডিওতে বসে রয়েছে, তারা শুনে যে আনন্দ-উদ্দীপনা অনুভব করেছে, তা প্রকাশ করতে পারেননি। কিন্তু মুক্ত এলাকায় বা শরণার্থী শিবিরে এই খবর প্রচণ্ড আনন্দ তুলেছিল।

কী বলেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় পার্লামেন্টের ঐতিহাসিক সেই অধিবেশনে? দৈনিক বাংলা পত্রিকায় ১৯৭২ সালে তার কিছু বিবরণ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ‘‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংসদের এক যুক্ত অধিবেশনে ঘোষণা করেন— ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি জানাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ একটি নতুন সার্বভৌম স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃত হলো।’ এই গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে উভয় সভার সদস্যরা দাঁড়িয়ে এই ঘোষণাকে স্বাগত জানান। তার এই ঘোষণা অধিকৃত এলাকার মানুষজনের মনে আনন্দ ছড়িয়ে দেয়। অনেক পরিবার সেদিন নিঃশব্দে মিষ্টি বিতরণ করেছিল। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান উপলক্ষে সেদিন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেরিত এক বার্তায় বলেন— ‘আমাদের দুই দেশের অনাবিল বন্ধুত্ব, শান্তি ও সহযোগিতার নবযুগ সূচনার প্রয়াসী।’ তারা বলেন, ‘আমাদের দুই বন্ধু দেশের একই শত্রুকে পরাজিত করার সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দিনের বিবৃতি প্রচারিত হয়। ইতিহাসের এই এক যুগান্তকারী দিন ৬ তারিখ অধিক আগ্রহের অবসান হয়েছিল। সেদিন বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা মানুষের প্রাপ্ত বাসনার প্রতিধ্বনি হয়েছে পার্লামেন্টের অধিবেশনে।’’

মুক্তিযোদ্ধা ও গণহত্যা বিষয়ক গবেষক ডা. এম এ হাসান মনে করেন, ইন্দিরা গান্ধী অপেক্ষা করে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যখন তারা একশভাগ নিশ্চিত হতে পেরেছেন যে, বাংলাদেশ জয়ী হতে পারবে, তখন তারা স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছেন। এর আগে যদি ঘোষণা দিতেন, তাহলে বিশ্বনেতারা মনে করতো, ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে ষড়যন্ত্র করছে। যখন সারাবিশ্ব ভয়াবহ গণহত্যার কথা জানলো, যখন স্বাধীন জাতিসত্তার কথা আসলো, ইন্দিরা গান্ধী তখন সারা বিশ্বে যোগাযোগ করলেন। ততদিনে বিষয়টি পরিপক্ক হয়েছে।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button