

জেমস রহিম রানা, নিজস্ব প্রতিনিধি,ঢাকা: আগামী ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে সারা দেশ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হতে পারে—এমন আতঙ্কের কথা বলে বাস ও লঞ্চ চলাচল বন্ধের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে পর্যায়ক্রমে সড়ক ও নৌপথে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ হতে পারে। গণসমাবেশ শেষে শনিবার রাতে আবারও সবকিছু স্বাভাবিক হবে। সড়ক-মহাসড়কে বিশেষ চেকপোস্টের মাধ্যমে পণ্যবাহী পরিবহন বা মোটরসাইকেলে নগরীতে যাত্রী প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হবে। একই সাথে ঢাকা বিভাগের পাঁচ জেলার লোকসমাগম ঠেকাতে নেওয়া হচ্ছে বিশেষ পরিকল্পনা। এর মধ্য দিয়ে দুদিন ঢাকা পুরোপুরি অচল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পরিবহন মালিক, শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে ধর্মঘটের ধরন হবে অঘোষিত। পরিবহন মালিকরা এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দিচ্ছেন না।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করছে, বিএনপির আগের নয়টি বিভাগীয় গণসমাবেশে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড না হলেও ঢাকার গণসমাবেশ ঘিরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হতে পারে। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও মনে করছে, বিএনপি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটাতে পারে। এ কারণে দলটির নেতাকর্মীরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নেতাকর্মীদের বুধবার থেকে পাড়া-মহল্লায় পাহারায় থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
সড়ক ও নৌপথের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, রাজধানীর বিভিন্ন উপজেলাসহ আশপাশের জেলা নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, কুমিল্লাসহ স্বল্প দূরত্বের মধ্যে থাকা নেতাকর্মীরা যেন কোনোভাবে ঢাকায় প্রবেশ করতে না পারেন, সেজন্য পথে পথে যানবাহন চলাচলে বেশ কড়াকড়ি আরোপ হতে পারে। যদিও এ বিষয়ে মঙ্গলবার পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বাস ও লঞ্চ মালিক সমিতি এবং শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তবে বাস ও লঞ্চে ১০ ডিসেম্বরের অগ্রিম টিকিট বিক্রি হচ্ছে না। বিলাসবহুল বাস কোম্পানির দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, যাত্রীরা আতঙ্কে আগামী শনিবারের কোনো টিকিট কাটছেন না। তবে দু-একটি কোম্পানির টিকিট বিক্রি হলেও বাস বন্ধের নির্দেশনা এলে টাকা ফেরত দেওয়া হবে।
সূত্রগুলো বলছে, মূলত সরকারের নির্দেশনার ওপর নির্ভর করছে যানবাহন চলাচল বন্ধের বিষয়টি। সরকার এ ব্যাপারে সবুজ সংকেত দিলেই বাস মালিকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন সড়ক পরিবহন সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন ও লঞ্চ মালিক সমিতি সম্মিলিতভাবে তা বাস্তবায়ন করবে।
জানতে চাইলে ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বলেন, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশ ঘিরে বাস বন্ধের বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি; কিংবা মালিকপক্ষও নেয়নি। তিনি বলেন, কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা বা ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা থাকলে বন্ধ হতে পারে যানবাহন চলাচল।
তিনি বলেন, বাস মালিকরা ক্ষতির আশঙ্কায় পড়লে বাস বন্ধ হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের কিছু বলার নেই। তবে এখন পর্যন্ত সে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, রাজধানীতে যানবাহন চলাচল বন্ধ হলে সারা দেশ অচল হতে পারে। যাত্রীদের ভোগান্তি লাঘবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া সঠিক হবে না। মালিক সমিতির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত যেন না নেয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, মালিকরা যদি গাড়ি দেয়, তাহলে আমাদের চালাতে কোনো আপত্তি নেই। গাড়ি যদি মালিকরা না চালানোর সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে শ্রমিকদের কিছুই করার থাকে না।
১০ ডিসেম্বর গণপরিবহন বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত নেই জানিয়ে বাস মালিকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, বিএনপির কর্মসূচির দিন সারা দেশে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক থাকবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বিভিন্ন বিভাগে বিএনপির সমাবেশের আগে ধর্মঘট ডেকেছিল পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। তাতে দুর্ভোগে পড়তে হয় ওইসব এলাকার মানুষকে। সব বিভাগের পর ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ হতে যাচ্ছে বিএনপির। ফলে, সে সময়ে পরিবহন ধর্মঘট হবে কিনা, তা নিয়ে রাজধানীবাসীর যেমন রয়েছে উদ্বেগ, তেমনি সারা দেশে গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যেতে পারে—এমন আশঙ্কাও অনেকের মধ্যেই রয়েছে। কারণ, এই সমাবেশে সারা দেশ থেকে ব্যাপক লোকসমাগম ঘটানোর পরিকল্পনা বিএনপির। তাই আগের চেয়ে বেশি জমায়েত ঠেকাতে সরকার গণপরিবহন বন্ধ করবে—এটা বিশ্বাস করেন বিএনপিপন্থি পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারাও। তবে ঢাকায় বিএনপির সমাবেশের স্থান নিয়ে টানাপোড়েন চললেও এখন পর্যন্ত গণপরিবহন ধর্মঘটের বিষয়টি পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতারা স্পষ্ট করছেন না। ধর্মঘট ডাকার ভাবনা তাদের নেই—এ কথাই বলার চেষ্টা করছেন।
গত অক্টোবরে চট্টগ্রামে জনসভা দিয়ে শুরু হয়েছিল বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের কর্মসূচি। চট্টগ্রামের পর খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, রংপুর, সিলেট, কুমিল্লা ও রাজশাহীতে জনসভা করে বিএনপি। এর মধ্যে কুমিল্লা বাদে আর সব সমাবেশের আগে সে অঞ্চলে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। ময়মনসিংহে ধর্মঘটের ঘোষণা না থাকলেও যানবাহন চলাচল বন্ধই ছিল। এ কারণে ঢাকাবাসীর মধ্যেও বিএনপির সমাবেশ ঘিরে পরিবহন ধর্মঘটের শঙ্কা জেগে উঠেছে। ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশ সামনে রেখে ধর্মঘটের কোনো কর্মসূচি আছে কিনা—জানতে চাইলে বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক শুভঙ্কর ঘোষ রাকেশ বলেন, আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। তিনি বলেন, এটা আমাদের একক কোনো সিদ্ধান্ত না। সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি আছে, বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন আছে, সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজনৈতিক সমাবেশ ঘিরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে তারা কিছুটা আতঙ্কিত থাকেন জানিয়ে রাকেশ বলেন, বিগত বছরগুলোয় আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে পরিবহনে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পরিবহন শ্রমিকদের মারধর করা হয়েছে।
পরিবহন ধর্মঘট ডাকা কিংবা না ডাকার বিষয়ে কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকার কথা বললেও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, ঢাকায় পরিবহন ধর্মঘট হবে না।
নৌ শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব মনিরুল ইসলাম মাস্টার বলেন, বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে লঞ্চ না চালানোর বিষয়ে শ্রমিকদের এখন পর্যন্ত কিছু জানানো হয়নি। যদি মালিকরা সেদিন লঞ্চ না চালান, তাহলে আমাদের করার কিছু নেই। কারণ, মালিকদের নির্দেশমতো আমাদের চলতে হয়।
গ্রিন লাইন পরিবহনের ম্যানেজার এম এ সাত্তার বলেন, ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের কোম্পানির টিকিট বিক্রি চলমান। ১০ ডিসেম্বর বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে যাত্রীরা টিকিট কাটছেন না। ফলে টিকিট বিক্রিও হচ্ছে না। তা ছাড়া আমরা এ ব্যাপারে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা পাইনি। তবে যাত্রীরা চাইলে আমরা টিকিট দেব।
১০ ডিসেম্বরের টিকিট বিক্রি প্রসঙ্গে সোহাগ পরিবহনের গাবতলী কাউন্টারের ম্যানেজার মিজান বলেন, আমরা এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা পাইনি। এজন্য অগ্রিম টিকিট বিক্রি হচ্ছে। তবে চাহিদা কম। বাস বন্ধের নির্দেশনা এলে যাত্রীদের টিকিটের টাকা ফেরত দেওয়া হবে।
মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক বলেন, আমরা বাস বন্ধের পক্ষে নই। যানবাহন চলাচল বন্ধের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমাদের সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, কোনো যানবাহন বন্ধ থাকবে না।
১০ ডিসেম্বর বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে গণপরিবহন বন্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট শিমুল বিশ্বাস বলেন, বাস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত শ্রমিক বা মালিকদের বিষয় নয়। সরকার সরাসরি এর সঙ্গে জড়িত। তবে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ ঘিরে গণপরিবহন বন্ধ রাখা, না রাখার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষ থেকেই ঘোষণা আসেনি। গাড়ি বন্ধ থাকলে মালিক ও শ্রমিক পক্ষ উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জনদুর্ভোগ বাড়ে। আমরা আগেও বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশে কোনো কারণ ছাড়াই যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিতে দেখেছি। এবারের কর্মসূচি ঘিরে সরকারের এরকম গণবিরোধী সিদ্ধান্তে যাওয়া অমূলক কিছু নয়।
নৌযান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা কামাল বলেন, আমরা তো বিএনপির আগের বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে নৌ ও সড়কপথ অচল করে দিতে দেখেছি। লোকসমাগম ঠেকানোর উদ্দেশ্য থেকেই এসব করা হচ্ছে। ১০ তারিখের কর্মসূচি বানচাল করতে এ ধরনের কাজ হবে না, তা বলা যাচ্ছে না।