আইন-আদালত

মামলায় জর্জরিত যশোরের বিএনপি নেতাকর্মীরা গ্রেফতার আতঙ্কে ভিটেছাড়া

# হরতাল অবরোধে ২২ মামলা, আসামি দেড় সহস্রাধিক, #আটক সাড়ে চারশ নেতাকর্মী

নিজস্ব প্রতিনিধি: বিএনপির চলমান হরতাল অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে মামলায় জর্জরিত যশোর বিএনপির নেতাকর্মীরা। গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া হরতাল আর অবরোধের চার দিনের কর্মসূচিতে ২২ মামলায় আসামি করা হয়েছে দেড় সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে। এসব মামলায় আটক করা হয়েছে সাড়ে চার শ’ নেতাকর্মী। গ্রেপ্তার আতঙ্কে বর্তমানে ঘরছাড়া জেলা বিএনপির শীর্ষনেতাসহ অন্তত পাঁচ হাজার নেতাকর্মী। এতে এসব নেতাকর্মীর পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার পাশাপাশি মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।

প্রত্যেকটি মামলার বাদী পুলিশ। বিস্ফোরক দ্রব্যে সজ্জিত হয়ে দেশকে অস্থিতিশীল ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটানোর উদ্দেশ্যে সমবেত হয়ে হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে মামলাগুলোতে। তবে বিএনপির নেতারা বলছেন এগুলো পুলিশের গায়েবি মামলা। শুধু তাই নয়, ঘটনা ঘটেনি অথচ পুলিশ নাটকীয় গল্প বানিয়ে মামলাগুলো দায়ের করেছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে নির্বাচনী মাঠ থেকে দূরে রাখতে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে একের পর এক মিথ্যা সাজানো মামলা দায়ের করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ নেতাকর্মীদের। নেতারা বলেছেন, গত কয়েক দিনের পরিস্থিতিতে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা কিছুটা থমকে গিয়েছিলেন; কিন্তু হতাশা নেই। মামলা, গ্রেপ্তার অভিযানের মুখেও আন্দোলনের কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে তারা এবার এর পরিণতি দেখতে চান। কারণ তাদের এখন পিছু হটার সুযোগ নেই। জেলা শীর্ষনেতাকর্মী গ্রেপ্তার অভিযানের মুখে অনেক নেতা আত্মগোপনে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা কারগারে এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আজ রোববার থেকে আবারও টানা দুই দিনের অবরোধ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে যশোর বিএনপি।

যশোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, কোনো কিছুই জানি না। অথচ যাত্রীবাহী পরিবহন থেকে ককটেলসহ নেতাকর্মী আটকের পর নতুন করে একটি মামলা দিয়েছে পুলিশ। এখন গ্রেপ্তারের ভয়ে আমরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। গ্রেপ্তার আতঙ্কে প্রায় পাঁচ হাজার নেতাকর্মী এখন ঘরছাড়া। তারপরও কর্মীরা মাঠে আছেন। নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছি, হঠকারী কিছু না করে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে।’

যশোরে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকায় মহাসমাবেশের এক দিন আগে থেকেই যশোরে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। গ্রেপ্তার আতঙ্কে অধিকাংশ নেতাকর্মী ঘরছাড়া। অধিকাংশ নেতাকর্মী পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। মামলার আসামিরা তো বটেই, মামলা নেই এমন নেতাকর্মীও বাড়িতে থাকতে সাহস পাচ্ছেন না। সর্বশেষ যশোরে বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে বিআরটিসি বাসে আগুন দেওয়ার অভিযোগে দলটির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করেছে। এরমধ্যে চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর আগে যশোর-নড়াইল সড়কের হামিদপুর এলাকা থেকে যাত্রীবাহী দুটি বাস থেকে বিএনপির ৬৬ নেতাকর্মীকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় বাসের ভেতর থেকে ককটেল, পেট্রল ও লাঠিসোটা জব্দ দেখিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, জেলার শীর্ষ নেতৃত্বসহ ৮৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ দুটি মামলায় জেলা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, এ পর্যন্ত হওয়া বেশির ভাগ রাজনৈতিক মামলাতেই অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে। নেতাকর্মীরা পালিয়ে বেড়ার কারণে চলমান অবরোধ কর্মসূচিতে শহরতলিতে দু-একটি ঝটিকা মিছিল ছাড়া কার্যত কোন আন্দোলন কর্মসূচি করতে পারছে না। একই সাথে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের রাজপথে লাঠি বাঁশ নিয়ে মহড়াতে দাঁড়াতে পারছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এছাড়া গ্রেফতার আতঙ্কে শহরের লালদীঘিপাড়ের দলীয় কার্যালয় এক সপ্তাহ ধরে নেতাকর্মীশূন্য। বন্ধ রয়েছে দলীয় কার্যালয়।

এদিকে একের পর এক মামলা গ্রেফতার আতঙ্কে যশোরের কেন্দ্রীয় নেতা অমিত, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সাবেরুল হক সাবু, যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকনসহ দলটির অঙ্গ সংগঠনগুলোর শীর্ষনেতৃবৃন্দ ভিটেছাড়া হয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। দলটির নেতারা বলছেন, গ্রেপ্তার ও মামলায় বিপর্যস্ত জেলার নেতারা তৃণমূল কর্মীদের দিকনির্দেশনা দিতে পারছেন না। আবার কেন্দ্র থেকেও কোনো নির্দেশনা পাচ্ছেন না তারা। নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশাও ভর করেছে।
মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা জানান, আন্দোলনে জেলা বা উপজেলার শীর্ষস্থানীয় নেতারা মাঠে না থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন। নেতারা মাঠে না থাকায় তৃণমূলের কর্মীরা কর্মসূচিতে অংশ নিতে ভরসা পাচ্ছেন না। সর্বশেষ হরতাল ও তিন দিনের অবরোধের কর্মসূচিতেও তার প্রভাব পড়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা ভোরে পৃথক পৃথক ঝটিকা মিছিল করে। বেলা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাজপথে দেখা যায়নি বিএনপি নেতাকর্মীদের। বিএনপির দাবি, পুলিশের মিথ্যা মামলা ও আ.লীগ নেতাকর্মীদের সশস্ত্র মহড়ায় মাঠে দাঁড়াতে পারছে না তারা।

অপরদিকে, গত এক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিজের নামে মামলার খবর পড়ে বিষয়টি স্বাভাবিকই মনে করেন বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। তার নামে গত এক সপ্তাহে মামলা হয়েছে ৪টি। সব মিলিয়ে তার ঘাড়ে বর্তমানে মামলা ঝুলছে ৬০টি। যশোর খুলনা, নড়াইল ঢাকাতে হওয়া সব মামলাগুলোই দেশকে অস্থিতিশীল ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটানোর উদ্দেশ্যে সমবেত হয়ে হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে মামলাগুলোতে। আবার সব মামলাগুলোরই বাদী পুলিশ। প্রায় একই পথের পথিক দলটির যশোর জেলা শাখার সদস্য সচিব সৈয়দ সাবেরুল হক সাবুও। অমিতের মতো তিনিও গত এক সপ্তাহে ৪টি মামলার আসামি হয়েছেন। সব মিলিয়ে তার ঘাড়ে ঝুলছে ৫৬টি মামলা। অমিত ও সাবুর মতো প্রায় দুই ডজন মামলার আসামি হয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকন, গোলাম রেজা দুলু, মিজানুর রহমান খান, কাজী আযম, সহযোগী সংগঠন যুবদলের সভাপতি এম তমাল, সাধারণ সম্পাদক আনছারুল হক রানা, সহ সভাপতি আমিনুর রহমান মধু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হোসেন বাবুল, সাংগঠনিক সম্পাদক কবির হোসেন বাবু, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি রবিউল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক আমির ফয়সাল, ছাত্রদলের সভাপতি রাজিদুর রহমান সাগর, সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান বাপ্পীসহ দলটির অঙ্গ সংগঠনগুলোর জেলা ও উপজেলার শীর্ষনেতাকর্মীরা। এসব নেতাকর্মীরা মামলা ঘাড়ে নিয়ে গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। মামলার আসামি হওয়ায় বাড়িতে ঘুমাতে পারছেন না তারা। পালিয়ে বেড়ানোয় স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হচ্ছে। গ্রেফতার আতঙ্কের মধ্যে নেতাকর্মীদের বাড়িতে ককটেল হামলা-ভাংচুর চালানোর অভিযোগ করছেন পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের বিরুদ্ধে। এতে তাদের স্বজনরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এছাড়া বিএনপির যশোর জেলা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক নার্গিস বেগমের বিরুদ্ধে কোন মামলা নেই। বিএনপি নেতা আইনজীবী আনিছুর রহমান মুকুল বলেন, দায়েরকৃত মামলাগুলো সাজানো। এজাহারে অসংখ্য অসঙ্গতি। একই এজাহারে একজনেরই নাম একাধিকবার রয়েছে।

দলটির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে মামলা আর নতুন কিছু নয়। গত ১৫ বছর ধরেই নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়েছে। কিছুদিন মিথ্যা মামলা দেয়া বন্ধ থাকলেও গত সপ্তাহখানেক ধরে আবারো নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ২২টি মামলা দেয়া হয়েছে। হয়তো আরো মামলা হবে। এই মামলা দিয়ে সরকার বিএনপির নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে চায়। কিন্তু রাজনীতি যারা করে তারা দৃঢ় মনোবল নিয়েই করে। আর এই স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে টিকে থাকতে হলে মনোবল দৃঢ় না হয়ে উপায় নেই।
তিনি আরো বলেন, মামলা হলে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়। তবে আমরা আমাদের আন্দোলন, সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। কোন হামলা মামলা আমাদের কিংবা আমাদের নেতাকর্মীদের মনোবল কমাতে পারবে না। যেহেতু মামলা হয়েছে তাই গ্রেপ্তার এড়াতে অনেক নেতাকর্মী নিরাপদ দূরত্বে রয়েছেন। অনেকে পুলিশি অভিযানের ভয়ে বাড়ি-ঘর ছাড়া।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বেলাল হোসাইন বলেন, গাড়ি ভাঙচুর করার সময় বিএনপির নেতাকর্মীদের আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া সুনির্দিষ্ট অপরাধের মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কাউকে উদ্দেশ্যমূলক মামলায় আসামি করা হচ্ছে না দাবি করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button