উপসম্পাদকীয়

সম্রাট-খালেদ কিংবা ছাত্রলীগ এখন গুরুত্বপূর্ণ যে কারণে

রুমিন ফারহানা

বাতাসে নির্বাচনের গন্ধ। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর একটির পর একটি সফরের মধ্যে দিয়ে ভোট চাওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে দলটি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতিটি সফরেই উদ্বোধন হচ্ছে কোটি টাকার প্রকল্প। কিন্তু এ প্রশ্ন তো তোলাই যায় যে– তফশিল ঘোষণার আগে এই ধরনের ভোট কি চাওয়া যায়? নির্বাচন কমিশনও নিশ্চিতভাবেই শক্ত ভূমিকা নিতে পারে এসব ক্ষেত্রে। কিন্তু এখানে এসব আলোচনা অবান্তর। তবে মজাটা হলো ভোট চাওয়ার প্রশ্ন আসে দেশে ভোটের ব্যবস্থা চালু থাকলে। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে আমার মনে হয়– আওয়ামী লীগ দল এবং সরকার মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরাতে বিশেষ করে বিরোধী দলের নানান কর্মসূচি থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতে ভোট চাওয়ার বিষয়টি সুচিন্তিত পরিকল্পনা।

আওয়ামী লীগের অধীনে দুটি সমালোচিত জাতীয় নির্বাচনের পর কী হতে যাচ্ছে আগামীর নির্বাচন ঘিরে, সেটি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে একদিকে যেমন আছে শংকা অন্যদিকে আছে নানা জল্পনা-কল্পনা। আওয়ামী লীগ বলছে তাদের পরিকল্পনা পরিষ্কার, সংবিধান মেনেই দলীয় সরকারের অধীনে হবে নির্বাচন। আর বিরোধী দলগুলোর দাবিও একটাই। সেই দাবি নিয়েই মাঠে আছে তারা। দলীয় সরকারের অধীনে আর কোনও নির্বাচন নয়। এমন অবস্থায় আওয়ামী লীগের সামনে দুইটা চ্যালেঞ্জ। একদিকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করা অন্যদিকে বিরোধী দলের আন্দোলন শক্তহাতে মোকাবিলা করা। এই দুই কাজ সুষ্ঠুভাবে সমাধার জন্য পুলিশ প্রশাসনের বাইরে আর যে শক্তি আওয়ামী লীগকে সাহায্য করতে পারে সেই শক্তিকে মাঠে নামানোর সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছে দলটি। তারই একটা ছোট নমুনা দেখা গেছে কিছুদিন আগে।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকা বলছে, ‘ভোটের আগে রাজনীতির মাঠে সম্রাট-খালেদরা’। খবরটি শুরু হয়েছে এভাবে– ক্যাসিনোকাণ্ডে বিতর্কিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের যেসব নেতা পদ হারিয়েছিলেন, তারা এখনও দলীয় পদে ফিরতে পারেননি। তবে পদ-পদবি না পেলেও তারা রাজনীতিতে ফিরতে শুরু করেছেন। এক সময় যেসব এলাকায় তাদের আধিপত্য ছিল, তা তারা ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় আছেন এখন।

যখন মহা হাঁকডাকে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়, তখনই নিশ্চিত ছিলাম, এটি এক ধরনের ‘আইওয়াশ’। দেখা গেছে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের তৃতীয়, চতুর্থ পর্যায়ের কর্মীর বাইরে এই অভিযান চলেনি। মন্ত্রী-এমপি দূরেই থাকুক, মূল দলের বড় কোনও পদে থাকা নেতার নামও এই অভিযানে আসেনি।

আওয়ামী লীগ নেতারাই অভিযানের কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে দুটি কারণকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। প্রথমত, পরপর দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা থেকে দলের ভাবমূর্তি ফেরানোর চেষ্টা হিসেবে সেই অভিযান পরিচালনা করা হয়। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের ভেতর দুটি অংশের মধ্যে বিরোধ চলছিল। এর বহিঃপ্রকাশ ছিল অভিযান। যেহেতু শুরু থেকেই এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো, সে কারণেই একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর থেমে যায় সবকিছু।

সময় পার হলে ধীরে ধীরে সকলেই ফিরতে থাকেন দলে। শোনা যায় পদ পদবি ফিরে না পেলেও শুদ্ধি অভিযানের অভিযুক্তরা ক্রমেই সক্রিয় হচ্ছেন রাজনীতিতে। উল্লিখিত পত্রিকার রিপোর্টটি বলছে, এই বিষয়ে যুবলীগ চেয়ারম্যান বলেন, ‘আইনি বাধা না থাকলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের যে কারো কর্মী হিসাবে কাজ করার সুযোগ আছে’। এ কথায় এটাই স্পষ্ট যে যত অভিযোগই থাকুক না কেন, যত বড় অপরাধীই হোক না কেন দল করতে সেগুলো কোনও বাধাই নয়। অবশ্য বাঁধা দূরেই থাকুক অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের অভিযোগ দলে মূল্যায়িত হতে সাহায্য করে। বিশেষ করে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে সরকার যখন পুলিশ প্রশাসনের বাইরে ভীষণভাবে নির্ভর করে দলীয় ক্যাডার বাহিনীর ওপর।

একই ধরনের যুক্তি সমানভাবে প্রযোজ্য ছাত্রলীগের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশে এমন কোনও বিশ্ববিদ্যালয় বাকি নেই যেখানে ছাত্রলীগ নানান অপকর্মের কারণে খবরের শিরোনাম হয়নি। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হল দখল, ধর্ষণসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত তাদের অনেকে। তবে তাদের বিরুদ্ধে খুব বেশি ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি দলকে। এর কারণ হিসাবে ইতোমধ্যেই একটি স্বনামধন্য পত্রিকাকে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে বলছেন, বিরোধী দলের আন্দোলন কর্মসূচি চলছে। এই পরিস্থিতিতে সংগঠনের ভেতর বড় ধরনের ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালানো কঠিন। কারণ, সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

ছাত্রলীগ লাঠিসোটা হাতে মাঠে থেকে বিরোধীদের ভয় দেখানো, পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠানোর মতো কাজ করেছে– এমন অনেক উদহারণ আছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে যুক্ত হয়েছে নতুন উদাহরণ। বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সতর্ক অবস্থান নিয়েছিল ছাত্রলীগ। এই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসের প্রবেশমুখসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোয় অবস্থান করেছিল। ক্যাম্পাসের অন্যতম প্রবেশমুখ নীলক্ষেতের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণের সামনে থেকে মুঠোফোন ঘেঁটে বিএনপি-সমর্থক ১০-১২ জনকে মারধর করে পুলিশে দিয়েছিল বলে জানিয়েছিল নিজেরাই।

আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীনরা পশ্চিমাদের চাপের মুখে আছে– এমন কথাও শোনা যায়। এই লক্ষ্যে পশ্চিমারা সরকারের বিরোধী দলের প্রতি আচরণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বিরোধী দলগুলো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণ স্বাধীনতা পাচ্ছে কিনা, তাদের ওপরে অনাবশ্যক বল প্রয়োগ করা হচ্ছে কিনা খেয়াল রাখা হচ্ছে সেসব। একই সাথে তারা খেয়াল করছেন বিরোধী দল সহ সকল নাগরিকের মানবাধিকার এবং মত প্রকশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হচ্ছে কিনা, এসব বিষয়েও। মানবাধিকার ইস্যুতে র‍্যাব এবং এর কর্মকর্তাদের ওপরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এসেছিল এক বছরের কিছু বেশি সময় আগে।

এটা খুব সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই বোঝা যায় যে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে শুধু র‍্যাবই নয়, দেশের সকল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পশ্চিমাদের নজরদারির মধ্যে থাকবে। এখানেই সম্রাট-খালেদরা এবং ছাত্রলীগ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। প্রকাশক ও সম্পাদক, ইত্তেহাদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button